Last Update : June 29, 2024
নবম শ্রেণির দ্বিতীয় অধ্যায় “ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক” অধ্যায়ে ১৭৮৯-এর ফরাসি বিপ্লবের নানাদিক আলোচিত হয়েছে। এই অধায়ে যা যা আলোচিত হয়েছে, তা সংক্ষেপে বললে এইরকম দাঁড়ায় –
- ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফরাসি সমাজের অবস্থা
- ফরাসি বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের রাজনৈতিক অবস্থা (রাজনৈতিক কারাগার)
- ফরাসি বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের অর্থনীতি (ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর)
- ফ্রান্সে প্রচলিত করব্যবস্থা
- বাস্তিল দুর্গ ও তার পতন
- স্টেটস জেনারেলের সভা ও ফরাসি সংবিধান সভা স্থাপন
- সংবিধান রচনা করা
- সামন্তপ্রথার বিলোপ ও মানুষ ও নাগরিকের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা
- ফরাসি বিপ্লবে নারী, গ্রাম্য মানুষ, সাঁকুলোৎদের অবদান
- বিপ্লবে জনচেতনার গুরুত্ব
- ফরাসি বিপ্লবের তিনটি মূল আদর্শ। ইত্যাদি
উপর্যুক্ত বিষয়গুলিকে সামনে রেখে আলোচিত হয়েছে ব্যাখ্যাধর্মী প্রশ্ন। প্রশ্নগুলির মান ৪।
“ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক” থেকে ব্যাখ্যাধর্মী প্রশ্ন, মান – ৪, নবম শ্রেণি, Class 9 History
প্র। টীকা লেখ : “রাজনৈতিক কারাগার”
(উত্তর) সূচনা : বুরবোঁ বংশে রাজা ষোড়শ লুইয়ের সময়ে ফ্রান্সে সংকটময় পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। দুর্বল রাজা এবং অন্যদিকে সুবিধাবাদী রাজপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ফ্রান্সের প্রশাসন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। এই অবক্ষয়িত সংকটময় ফ্রান্সকে (বাস্তিল দুর্গ) ভলতেয়ার ‘রাজনৈতিক কারাগার’ বলে অভিহিত করেছেন।
রাজনৈতিক কারাগার
- ত্রুটিপূর্ণ আইন ও বিচারব্যবস্থা : বিপ্লব পূর্ববর্তী ফ্রান্সে নির্দিষ্ট আইনবিধি ছিল না। রাজার অনুশাসন বা আদেশ আইন বলে গণ্য হত। অন্যদিকে বিচারব্যবস্থা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত। ফলত ফ্রান্স সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।
- পরোয়ানাসমূহ : ফ্রান্সে প্রচলিত ‘লেতর-দ্য-ক্যাশে’ এবং ‘লেত্র-দ্য-গ্রেস’ পরোয়ানাগুলির মাধ্যমে ইচ্ছানুযায়ী যে-কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, বিনাবিচারে আটক কিংবা মুক্তি দেওয়া যেত। সাধারণত বাস্তিল দুর্গে সেইসব ব্যক্তিদের আটকে রাখা হত।
- সংকটাপন্ন ফ্রান্স : সংস্কারবিমুখ রাজতন্ত্র, দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারব্যস্থা, সঠিক আইনবিধির অভাব, যাজক শ্রেণির প্রতিপত্তি–এইসব কারণে ফ্রান্স হয়ে উঠেছিল সাধারণ সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে অসহনীয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভলতেয়ার স্বৈরাচারের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ তথা ফ্রান্সকে ‘রাজনৈতিক কারাগার’ বলেছেন।
প্র। বাস্তিল দুর্গের পতন ও গুরুত্ব লেখ।
(উত্তর) স্বৈরাচারের প্রতীক : বাস্তিল দুর্গ ছিল ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের দুর্গ। এই দুর্গে রাজতন্ত্রের বিরোধী ব্যক্তিদের বন্দি করে রাখা হত ও অত্যাচার করা হত। তাই জনগণের কাছে বাস্তিল দুর্গ ছিল ফরাসি রাজতন্ত্রের অত্যাচারের প্রতীক। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের বিদ্রোহী জনগণ বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে ধ্বংস করেছিল।
পতনের কারণ : ফ্রান্সের জনগণ বিভিন্ন কারণে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়েছিল। তাছাড়া প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে সম্রাট ষোড়শ লুই অর্থমন্ত্রী নেকার-কে পদচ্যুত করলে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে এবং জনগণ বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে।
বাস্তিল দুর্গ অক্রমণ ও ধবংস : প্যারিস শহরের উত্তেজিত জনতা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গ দখল করে ধ্বংস করে দেয়।
গুরুত্ব :
- বাস্তিল দুর্গ ছিল ফ্রান্সের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক। তাই বাস্তিল দুর্গের পতনের ফলে ফরাসি রাজতন্ত্রের ক্ষমতার দৈন্যদশা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
- ফরাসি রাজতন্ত্রের গর্বের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ ধ্বংসের ঘটনা ফরাসি বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে।
- বাস্তিল দুর্গের পতন প্রমাণ করেছিল যে, রাজধানী প্যারিসের উপর ফরাসি সম্রাটের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
- এই দুর্গের পতনের পর প্যারিস শহরের নিয়ন্ত্রণ বিপ্লবীদের হাতে চলে যায়।
প্র। ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল?
(উত্তর) ১. সামাজিক বিভাজন : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের জনসাধারণ তিনটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল – প্রথম সম্প্রদায়, দ্বিতীয় সম্প্রদায় ও তৃতীয় সম্প্রদায় (Third Estate)।
১.১ প্রথম সম্প্রদায় : যাজকেরা ছিলেন প্রথম সম্প্রদায়ভুক্ত। ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ শতাংশ ছিলেন যাজক। এঁরা ভূমিকর, ধর্মকর, বিবাহকর, মৃত্যুকর প্রভৃতি আদায় করলেও সরকারকে স্বেচ্ছাকর ছাড়া অন্য কোনো কর দিতেন না। কর না দিলেও এঁরা রাষ্ট্রের সবরকম সুযোগসুবিধা ভোগ করতেন।
১.২ দ্বিতীয় সম্প্রদায় : অভিজাতরা ছিলেন দ্বিতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত। দেশের মোট জনসংখ্যার ১ থেকে ১.৫ শতাংশ ছিল অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত। ফ্রান্সের মোট জমির ২০ শতাংশ ছিল এদের দখলে। এঁরা প্রজাদের কাছ থেকে বিভিন্ন কর আদায় করলেও সরকারকে কোনো কর দিতেন না। এঁরাও ছিলেন সুবিধাভোগী শ্রেণি-র অন্তর্গত।
১.৩ তৃতীয় সম্প্রদায় (Third Estate) : ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশের বেশি ছিল তৃতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, চাকুরিজীবী, ডাক্তার, অধ্যাপক, শ্রমিক, মালিক, মজুর প্রমুখ। এঁরা রাষ্ট্র থেকে কোনো সুযোগসুবিধা পেতেন না, কিন্তু রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রকার কর দিতে বাধ্য ছিলেন। আর্থিক শোষণ থেকে মুক্তির জন্য এরা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন।
২. ফ্রান্সের আর্থিক অবস্থা : ফ্রান্সের ভ্রান্ত আর্থিক অবস্থা ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। ফ্রান্সের রাজস্বব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। সরকারের বিলাসিতা, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ফ্রান্সের পরিস্থিতিকে ভয়ংকর করে তুলেছিল। এই সব কারণে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তৎকালীন ফ্রান্সকে ‘ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর’ বলেছেন।
- ত্রুটিপূর্ণ করব্যবস্থা : ফ্রান্সে কর আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো নীতি ছিল না। অভিজাত ও যাজকরা ছিলেন ফ্রান্সের বেশিরভাগ জমির মালিক। অথচ তাঁরা কর দিতেন সরকারের আয়ের মাত্র ৪ শতাংশ। আর মোট রাজস্বের বাকি কর দিতে হত দরিদ্র কৃষকদের।
- প্রত্যক্ষ কর : ফ্রান্সে তিন ধরনের প্রত্যক্ষ কর আদায় করা হত – টেইলি বা ভূমিকর, ক্যাপিটেশন বা উৎপাদন কর, ভিংটিয়েমে বা আয়কর। প্রত্যেকটি কর সাধারণ জনগণের কাছ থেকে আদায় করা হত।
- অন্যান্য কর : এ ছাড়াও দিতে হত গ্যাবেলা বা লবণ কর, টাইদ বা ধর্মকর, এইদস, তেরাজ প্রভৃতি।
- করভি : আবার রাস্তাঘাট নির্মাণ বা সংস্কারের সময় সাধারণ মানুষদের বাধ্যতামূলক বেগার খাটতে হত। একে বলা হত করভি বা শ্রমকর।
- এইসব কর দিতে কৃষকদের আয়ের ৮০ শতাংশ চলে যেত। অপরদিকে অভিজাত ও যাজকদের আর্থিক ক্ষমতা থাকলেও নানা কারণে তারা কর প্রদান থেকে অব্যাহতি পেত। ফ্রান্সের রাজাদের বেহিসাবি অর্থব্যয়ের ফলে ফ্রান্সের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল।
প্র। ফরাসি সমাজে দৈবরাজতন্ত্রের ধারণা কীরূপ ছিল?
(উত্তর) দৈব রাজতন্ত্র কী : যে রাজতন্ত্রে রাজারা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে মনে করতেন, ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন এবং নিজেরা ইচ্ছানুসারে সীমাহীন স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে দেশ শাসন করতেন, তাকে ‘দৈব রাজতন্ত্র’ বলা হয়।
ফরাসি রাজতন্ত্র : ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজতন্ত্র ছিল দৈব রাজতন্ত্র। কারণ –
- রাজারা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাসী : ফ্রান্সের রাজারা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন। ফরাসি জনগণের মতামতের কোনো মূল্য ছিল না। রাজা তাঁর কাজের জন্য কারোর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলেন না।
- স্বৈরাচারী শাসন : ফ্রান্সের রাজারা ছিলেন দেশের সর্বোচ্চ শাসক, আইন প্রণেতা ও বিচারক। রাজাদের ইচ্ছাই ছিল আইন। সম্রাট চতুর্দশ লুই বলেছিলেন, ‘I am the State’। সম্রাট ষোড়শ লুই বলতেন, ‘আমি যা ইচ্ছা করি তাই আইন’।
এই মতের সমালোচনা : ফরাসি সম্রাট দৈবক্ষমতা দাবি করলেও বাস্তবে তাঁর ক্ষমতা সীমিত ছিল। কারণ রাজকীয় ক্ষমতার উপর ফ্রান্সের প্রাদেশিক সভা বা পার্লামেন্টের সীমাহীন প্রভাব ছিল। রাজা কোনো আদেশ জারি করলে সেই আদেশকে প্রাদেশিক সভার অনুমোদন পেতে হত। প্রাদেশিক সভার সদস্য যাজক ও অভিজাতরা বিরোধিতা করলে রাজা কিছু করতে পারতেন না। তা অনেকে বলেছেন যে, ‘ফরাসি রাজতন্ত্র ছিল আসলে সামন্ত রাজতন্ত্র’।
প্র। “বিপ্লব-পূর্ব ফ্রান্স ছিল রাজনৈতিক কারাগার ও ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর” – ব্যাখ্যা কর।
(উত্তর) সূচনা : বুরবোঁ বংশে রাজা ষোড়শ লুইয়ের সময়ে ফ্রান্সে সংকটময় পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। দুর্বল রাজা এবং অন্যদিকে সুবিধাবাদী রাজপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ফ্রান্সের প্রশাসন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। এই অবক্ষয়িত সংকটময় ফ্রান্সকে (বাস্তিল দুর্গ) ভলতেয়ার ‘রাজনৈতিক কারাগার’ বলে অভিহিত করেছেন।
রাজনৈতিক কারাগার
- ত্রুটিপূর্ণ আইন ও বিচারব্যবস্থা : বিপ্লব পূর্ববর্তী ফ্রান্সে নির্দিষ্ট আইনবিধি ছিল না। রাজার অনুশাসন বা আদেশ আইন বলে গণ্য হত। অন্যদিকে বিচারব্যবস্থা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত। ফলত ফ্রান্স সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।
- পরোয়ানাসমূহ : ফ্রান্সে প্রচলিত ‘লেতর-দ্য-ক্যাশে’ এবং ‘লেত্র-দ্য-গ্রেস’ পরোয়ানাগুলির মাধ্যমে ইচ্ছানুযায়ী যে-কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, বিনাবিচারে আটক কিংবা মুক্তি দেওয়া যেত। সাধারণত বাস্তিল দুর্গে সেইসব ব্যক্তিদের আটকে রাখা হত।
- সংকটাপন্ন ফ্রান্স : সংস্কারবিমুখ রাজতন্ত্র, দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারব্যস্থা, সঠিক আইনবিধির অভাব, যাজক শ্রেণির প্রতিপত্তি–এইসব কারণে ফ্রান্স হয়ে উঠেছিল সাধারণ সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে অসহনীয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভলতেয়ার স্বৈরাচারের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ তথা ফ্রান্সকে ‘রাজনৈতিক কারাগার’ বলেছেন।
ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর
ফ্রান্সের ভ্রান্ত আর্থিক অবস্থা ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। ফ্রান্সের রাজস্বব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। সরকারের বিলাসিতা, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ফ্রান্সের পরিস্থিতিকে ভয়ংকর করে তুলেছিল। এই সব কারণে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তৎকালীন ফ্রান্সকে ‘ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর’ বলেছেন।
- ত্রুটিপূর্ণ করব্যবস্থা : ফ্রান্সে কর আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো নীতি ছিল না। অভিজাত ও যাজকরা ছিলেন ফ্রান্সের বেশিরভাগ জমির মালিক। অথচ তাঁরা কর দিতেন সরকারের আয়ের মাত্র ৪ শতাংশ। আর মোট রাজস্বের বাকি কর দিতে হত দরিদ্র কৃষকদের।
- প্রত্যক্ষ কর : ফ্রান্সে তিন ধরনের প্রত্যক্ষ কর আদায় করা হত – টেইলি বা ভূমিকর, ক্যাপিটেশন বা উৎপাদন কর, ভিংটিয়েমে বা আয়কর। প্রত্যেকটি কর সাধারণ জনগণের কাছ থেকে আদায় করা হত।
- অন্যান্য কর : এ ছাড়াও দিতে হত গ্যাবেলা বা লবণ কর, টাইদ বা ধর্মকর, এইদস, তেরাজ প্রভৃতি।
- করভি : আবার রাস্তাঘাট নির্মাণ বা সংস্কারের সময় সাধারণ মানুষদের বাধ্যতামূলক বেগার খাটতে হত। একে বলা হত করভি বা শ্রমকর।
- এইসব কর দিতে কৃষকদের আয়ের ৮০ শতাংশ চলে যেত। অপরদিকে অভিজাত ও যাজকদের আর্থিক ক্ষমতা থাকলেও নানা কারণে তারা কর প্রদান থেকে অব্যাহতি পেত। ফ্রান্সের রাজাদের বেহিসাবি অর্থব্যয়ের ফলে ফ্রান্সের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল।
প্র। টেনিস কোর্টের শপথ
(উত্তর) ভূমিকা : ফরাসি বিপ্লবের শুরুর দিকের অন্যতম প্রধান ঘটনা ছিল ‘টেনিস কোর্টের শপথ’। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন ফ্রান্সের জাতীয়সভার প্রতিনিধিরা টেনিস কোর্টের মাঠে সমবেত হয়ে যে শপথ গ্রহণ করেছিলেন তা ‘টেনিস কোর্টের শপথ’ নামে পরিচিত।
টেনিস কোর্টের শপথ
পটভূমি : ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুই ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে জাতীয়সভার অধিবেশন আহ্বান করেন। এই অধিবেশনে তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা মাথাপিছু ভোটদানের অধিকার দাবি করেন। কিন্তু সম্রাট তৃতীয় শ্রেণির এই দাবি নাকচ করে দেন। তখন তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা মিরাবো, লাফায়েৎ ও আবে সিয়েসের নেতৃত্বে পার্শ্ববর্তী টেনিস কোর্টের মাঠে সমবেত হয়ে শপথ গ্রহণ করেন।
শপথ ও দাবি : তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা টেনিস কোর্টের মাঠে শপথ নিয়েছিলেন যে – ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা না করা পর্যন্ত তাঁরা এই স্থান ত্যাগ করবেন না। তাঁদের দাবি ছিল – (১) তৃতীয় শ্রেণির সদস্যদের মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নিতে হবে, (২) তাঁদের একটি নতুন সংবিধান রচনার অধিকার দিতে হবে।
গুরুত্ব : তৃতীয় শ্রেণির সদস্যদের মাথাপিছু ভোট ও নতুন সংবিধান রচনার দাবি সম্রাট ষোড়শ লুই শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হন এবং ২৭ জুন পুনরায় জাতীয়সভার অধিবেশন আহ্বান করেন। ফলে ফরাসি বিপ্লবের পথ সুগম হয়।
প্র। টীকা – থার্ড স্টেট / তৃতীয় সম্প্রদায়
(উত্তর) তিন সম্প্রদায় : অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের সমাজ ‘তিনটি সম্প্রদায়’ বা এস্টেট (Estate)-এ বিভক্ত ছিল। এই তিনটি এস্টেট বা সম্প্রদায় হল –
- যাজক : প্রথম সম্প্রদায় বা ফার্স্ট এস্টেট।
- অভিজাত : দ্বিতীয় সম্প্রদায় বা সেকেন্ড এস্টেট।
- অন্যান্য সাধারণ মানুষ : তৃতীয় সম্প্রদায় বা থার্ড এস্টেট। ফরাসি সমাজে তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত ছিলেন যাজক ও অভিজাতরা বাদে সমগ্র দেশবাসী।
আবার আর্থিক অবস্থা ও সামাজিক মর্যাদার বিচারে ফরাসি সমাজ দুভাগে বিভক্ত ছিল –
- সুবিধাভোগী শ্রেণি : এর মধ্যে ছিলেন যাজক ও অভিজাতরা।
- সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণি : এর মধ্যে ছিলেন তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ।
জনসংখ্যা : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই কোটি। এর মধ্যে প্রায় ৯৭% মানুষ ছিলেন তৃতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত।
শ্রেণিবিভাগ : শিক্ষিত ধনী থেকে শুরু করে সব থেকে দরিদ্রতম মানুষ পর্যন্ত সকলেই ছিলেন তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত। তবে তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে অনেক উপশ্রেণি ছিল, যেমন – বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক, ভবঘুরে (সাঁকুলোৎ) প্রভৃতি।
বুর্জোয়া : তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল বুর্জোয়া। বুর্জোয়ারা তিন ভাগে বিভক্ত ছিলেন –
- উচ্চ বুর্জোয়া : বড়ো ব্যবসায়ী, শিল্পপতি প্রভৃতি।
- মধ্য বুর্জোয়া : চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষক, সাহিত্যিক, দার্শনিক প্রমুখরা।
- নিম্ন বুর্জোয়া : ছোটো ব্যবসায়ী, দোকানদার, কারিগর, কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতি।
বুর্জোয়া শ্রেণি ছিল ফরাসি সমাজে বিদ্যা, বুদ্ধি ও ধনবলে সবচেয়ে বেশি বলীয়ান। তবে বংশকৌলিন্য ছিল না বলে সমাজে তাদের মর্যাদা ছিল না। তবে বুর্জোয়া শ্রেণি ছিল ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের অগ্রদূত।
কৃষক : তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে কৃষকরা ছিলেন সবচেয়ে বেশি। ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার ৮০% ছিলেন কৃষক। কৃষকদের মধ্যেও নানা ভাগ ছিল – স্বাধীন কৃষক, ভাগচাষি, ক্ষেতমজুর ও ভূমিদাস প্রভৃতি। ফরাসি সমাজে কৃষকরাই সবচেয়ে বেশি শোষিত হতেন। তারা সরকার, সামন্ত ও গির্জাকে নানা ধরনের কর দিতে বাধ্য হতেন।
আবে সিয়েসের বক্তব্য : আবে সিয়েস-এর মতে তৃতীয় সম্প্রদায় হল একটি সম্পূর্ণ জাতি।
প্র। ফ্রান্সের বিপ্লব-পূর্ব কর ব্যবস্থার পরিচয় দাও।
(উত্তর) বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজবংশের রাজারা রাজত্ব করতেন। রাজাদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল প্রজাদের কাছ থেকে আদায় করা বিভিন্ন ধরনের কর। ফরাসি প্রজাদের রাজা, জমিদার ও চার্চকে বিভিন্ন ধরনের কর দিতে হত।
কর কারা দিত : সমাজের উচ্চতর শ্রেণি অর্থাৎ যাজক ও অভিজাতরা কোনোপ্রকার করই দিত না। করের অধিকাংশ আসতো তৃতীয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে। কৃষক, বুর্জোয়া, শ্রমিক প্রভৃতি শ্রেণির মানুষেরা করের বোঝা বহন করতো।
প্রত্যক্ষ কর : ফ্রান্সে তিন ধরনের প্রত্যক্ষ কর আদায় করা হত – (১) টেইলি বা ভূমিকর। (২) ক্যাপিটেশন বা উৎপাদন কর। (৩) ভিংটিয়েমে বা আয়কর।
অন্যান্য কর : এ ছাড়া ফ্রান্সের জনগণকে দিতে হত টাইথ বা ধর্মকর, গ্যাবেলা বা লবণকর, এইট্স বা ভোগ্যপণ্য কর, তেরাজ (পেয়াজ) বা পথঘাট ব্যবহারের কর প্রভৃতি।
সরকার বণিকদের কাছ থেকে ব্যাবসাবাণিজ্য করার জন্য বাণিজ্য শুল্ক আদায় করত।
করভি : ফ্রান্সের জনগণকে শাসক শ্রেণির ইচ্ছা অনুযায়ী বাধ্যতামূলক বেগার খাটতে হত। এই বেগার শ্রমকরের নাম ছিল করভি।
ভ্রান্ত করব্যবস্থা : সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির উপর বিরাট করের বোঝা বহন করতে হত। অথচ সুবিধাভোগী শ্রেণি অনুদান ছাড়া কোনো করই দিত না। এইকারণে এই বৈষম্যমূলক করব্যবস্থা ফ্রান্সের তৃতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল।
প্র। ফরাসি কর ব্যবস্থা বৈষম্যমূলক ছিল কেন?
(উত্তর) বৈষম্যমূলক করব্যবস্থা : ফ্রান্সের করব্যবস্থা বৈষম্যমূলক ছিল কারণ –
- ফরাসি রাজাদের সুনির্দিষ্ট কোনো রাজস্ব-নীতি ছিল না।
- অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল।
- ফ্রান্সে প্রত্যক্ষ করের বোঝা দরিদ্র মানুষকেই বহন করতে হত।
- যাজক ও অভিজাতরা কোনো প্রকার কর দিতেন না। ফলত করের বোঝা সকলের ওপর সমান ছিল না।
- কর আদায়ের ব্যবস্থাও ছিল ত্রুটিপূর্ণ।
কর প্রদানকারী : ফ্রান্সে আদায় করা মোেট করের ৯৬ শতাংশ কর দিতে হত তৃতীয় সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে। অপরদিকে মাত্র ৪ শতাংশ কর দিত প্রথম ও দ্বিতীয় সম্প্রদায়।
কর আদায় ব্যবস্থা : ফ্রান্সে কর আদায়ের ব্যবস্থাও ছিল ত্রুটিপূর্ণ। সরকার এককালীন কর আদায়ের জন্য ‘ইনটেনডেন্ট’ নামক কিছু রাজকর্মচারী ও অভিজাতদের কর আদায়ের দায়িত্ব দিত। এই কর আদায়কারীরা প্রজাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট করের অতিরিক্ত কর আদায় করে নিত। বাড়তি কর আদায়ের জন্য তারা প্রজাদের অকথ্য অত্যাচারও করত।
এইসব কারণে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তৎকালীন ফ্রান্সকে ‘ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর’ বা Museum of Economic Errors বলে অভিহিত করেছেন।
প্র। সন্ত্রাসের শাসনের অবদান লেখ। বা সন্ত্রাসের রাজত্বের ঐতিহাসিক তাৎপর্য লেখ।
(উত্তর) সূচনা : ফ্রান্সে রোবসপিয়র-এর নেতৃত্বে জেকোবিন দল ১৭৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে যে শাসন চালিয়েছিল তা ইতিহাসে ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ বা ‘সন্ত্রাসের শাসন’ নামে পরিচিত। এই সন্ত্রাসের রাজত্ব ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের জুন থেকে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই পর্যন্ত মোট ১৩ মাস ধরে চলেছিল।
প্রেক্ষাপট :
- ফ্রান্সের ‘ন্যাশনাল কনভেনশন’ ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ষোড়শ লুইকে মৃত্যুদণ্ড দিলে ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া প্রভৃতি রাজতান্ত্রিক দেশগুলি একজোট হয়ে ফ্রান্সের বিরোধিতা করে।
- ফ্রান্সের অভ্যন্তরে বহু প্রদেশে বিদ্রোহ শুরু হয়। এছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব প্রজাতান্ত্রিক সরকারের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলে। এই অবস্থায় প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য রোবসপিয়র সন্ত্রাসের শাসন শুরু করেন।
উদ্দেশ্য :
- ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ফ্রান্সের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা।
- ফ্রান্সের অভ্যন্তরে নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম স্বাভাবিক রাখা।
- অভিজাত ভূস্বামীদের জমি বাজেয়াপ্ত করে তা কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা।
- বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠন করে ফ্রান্সের নিরাপত্তা ও সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
সন্ত্রাসের ভয়াবহতা : সন্ত্রাসের রাজত্বকালে প্রায় ৫০ হাজার নরনারীকে গিলোটিন যন্ত্রে হত্যা করা হয়। সন্দেহের আইনে লক্ষাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাছাড়া অনেক মানুষ নিখোঁজ হয়ে যান, যাদের অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
অবসান : ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই জেকোবিন, জিরন্ডিন ও মধ্যপন্থী দলের আতঙ্কিত সদস্যরা রোবসপিয়র ও তাঁর অনুগামীদের বন্দি করে। ২৮ জুলাই রোবসপিয়র ও তাঁর অনুগামীদের গিলোটিন-এ হত্যা করা হয়। ফলে সন্ত্রাসের শাসনের অবসান ঘটে।
প্র। ফরাসি সংবিধান সভার কার্যাবলি লেখ। অথবা, টীকা লেখ – নতুন ফরাসি সংবিধান সভা
(উত্তর) কবে গঠিত হয় : তৃতীয় সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই সংবিধান সভা গঠিত হয়।
সংবিধান সভার কৃতিত্ব : সংবিধান সভা ফ্রান্সের জন্য একটি সংবিধান রচনা করেছিল। তবে সংবিধান রচনার পূর্বে সংবিধান সভা দুটি উল্লেখযোগ্য কাজ করে –
- সামন্তপ্রথার অবসান : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট সংবিধান সভা এক প্রস্তাবের মাধ্যমে সামন্তপ্রথার বিলুপ্তির কথা ঘোষণা করে। এর ফলে অভিজাতদের সামন্তপ্রথা সংক্রান্ত সুযোগসুবিধাগুলি লোপ পায়।
- মানবিক ও নাগরিক অধিকারের ঘোষণা : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট সংবিধান সভা ব্যক্তি-নাগরিকের অধিকার ঘোষণা করে। এতে বলা হয় – স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার এবং সব মানুষের অধিকার সমান, আইনের চোখে সবাই সমান ইত্যাদি।
নতুন সংবিধান : সংবিধান সভা ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা করেছিল। এই সংবিধানে,
- রাজার ক্ষমতা হ্রাস করা হয় এব্বং আইনসভাকে সমস্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়।
- সামন্তপ্রভুদের বিচারালয়গুলি তুলে দিয়ে বিচারবিভাগকে নতুনভাবে সাজানো হয়,
- আইন, বিচার ও শাসন বিভাগকে পৃথক করে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ইত্যাদি।
এককথায় সংবিধান সভা পুরাতনতন্ত্রকে ধ্বংস করে, রাজার ক্ষমতা লোপ করে। পাশাপাশি এই সভা ‘ব্যাক্তি-নাগরিক অধিকার’ ঘোষণা করে প্রগতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়।
প্র। টীকা – সাঁকুলোৎ
(উত্তর) সাঁকুলোৎ কারা : ‘সাঁকুলোৎ’ বলতে বোঝায় শহরের নীচুতলার দরিদ্র মানুষদের, যাদের অধিকাংশই নিরক্ষর ও খেটে খাওয়া মানুষ। কায়িক পরিশ্রমই ছিল এদের একমাত্র মূলধন।
বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ : এই সাঁকুলোৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিলেন কারখানার শ্রমিক, মজুর, কারিগর, মুটে, মালি, চাকর, রাজমিস্ত্রি, কাঠুরে, জেলে, জলবাহক প্রভৃতি।
সাঁকুলোৎদের জনসংখ্যা : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্যারিস শহরের অধিকাংশ মানুষ ছিলেন সাঁকুলোৎ সম্প্রদায়ের। প্যারিসের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশ (প্রায় ৪ লক্ষের বেশি) মানুষই ছিলেন তৃতীয় সম্প্রদায়ের। এদের মধ্যে একটি বড়ো অংশ ছিল সাঁকুলোৎ।
বিভিন্ন দিক :
- এরা শহরের নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করত।
- এরা গা-গতরে কাজ করে পেট চালাত, কাজ না থাকলে ভিক্ষাও করত।
- এদের অনেকে অসামাজিক কজেও যুক্ত থাকত।
- শহরের ধনী মানুষদের কাছে এরা ছিল ঘৃণিত।
বিপ্লবে সাঁকুলোৎদের ভূমিকা : তবে বলা যায় সাঁকুলোৎরা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গের পতন থেকে শুরু করে নানাভাবে ফরাসি বিপ্লব-এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত ছিল। বিপ্লবের সময়ে এরা তৃতীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিপ্লবকে একটি গণবিদ্রোহে রূপান্তরিত করেছিলেন। বাস্তিল দুর্গের পতন থেকে শুরু করে সমগ্র ফরাসি বিপ্লবে এদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
প্র। ফরাসি বিপ্লবের জন্য ফরাসি রাজতন্ত্র কতটা দায়ী ছিল?
(উত্তর) ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে বিপ্লবের সময় বুরবোঁ রাজবংশ রাজত্ব করত। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লবের জন্য অনেক ঐতিহাসিক ফরাসি রাজতন্ত্রকে দায়ী করেছেন। তাঁরা বুরবোঁ শাসকদের দুর্বলতা, অস্থির মনোভাব ও অদূরদর্শিতাকে এই বিপ্লবের জন্য বহুলাংশে দায়ী করেছেন।
বুরবোঁ রাজতন্ত্রের দায়িত্ব :
- স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র : চতুর্দশ লুই থেকে ষোড়শ লুই পর্যন্ত সকল বুরবোঁ বংশীয় শাসকই ছিলেন স্বৈরাচারী। এঁদের শাসনের কোনো গণভিত্তি ছিল না।
- রাজন্যবর্গের দুর্বলতা : রাজা চতুর্দশ লুই, পঞ্চদশ লুই প্রমুখ ছিলেন বিলাসী, অলস। শাসনকার্যে এঁদের দুর্বলতার সুযোগে রাজকর্মচারীরা দেশে যথেচ্ছাচার শুরু করেছিলেন।
- প্রশাসনিক ত্রুটি : বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে বুরবোঁ শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ‘লেতর দ্য ক্যাশে’-এর অপব্যবহার, ইনটেনডেন্ট নামক রাজস্ব আদায়কারীদের শোষণ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল।
- বিপ্লবের অনিবার্যতা : রাজন্যবর্গের যুদ্ধনীতি, বিলাসব্যসন, অমিতব্যয়িতা প্রভৃতির ফলে বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্স চরম অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়। সংকট থেকে মুক্তি পাবার জন্য রাজা ষোড়শ লুই তুর্গো, নেকার, ক্যালোন, ব্রিয়াঁ প্রমুখ অর্থমন্ত্রীর সাহায্যে বিভিন্ন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু স্বার্থান্বেষী অভিজাতদের বিরোধিতার ফলে তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষপর্যন্ত তিনি স্টেটস্ জেনারেলের অধিবেশন ডাকলে বিপ্লব অনিবার্য হয়ে ওঠে।
বক্তব্য : উপরোক্ত কারণগুলির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ফরাসি বিপ্লবের জন্য বুরবোঁ রাজবংশের নানাবিধ অযোগ্যতা অন্যতম কারণ হলেও একমাত্র কারণ নয়। সামাজিক বৈষম্য, দুর্নীতিগ্রস্ত চার্চ, স্বার্থান্বেষী অভিজাত শ্রেণি, বুর্জোয়া শ্রেণির বিপ্লবমনস্কতার সঙ্গে বুরবোঁ রাজবংশের ভূমিকা একত্রিত হয়ে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করেছিল।
প্র। মানুষ ও নাগরিকের অধিকার সম্পর্কে লেখ।
(উত্তর) ফরাসি সংবিধান সভার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট ‘মানুষ ও নাগরিকের অধিকার ঘোষণা’। এই ঘোষণাপত্রটি অষ্টাদশ শতকের দার্শনিক মতবাদের ভিত্তিতে রচিত। এটিকে ‘১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের সংবিধানের ভূমিকা’ বা মুখবন্ধ বলা হয়।
মানুষ ও নাগরিক অধিকার ঘোষণা : ঘোষণাপত্রে বলা হয় –
- মানুষের জন্মগত অধিকার হল স্বাধীনতা।
- আইনের চোখে সকলেই সমান।
- মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মাচরণের স্বাধীনতা।
- রাজপদে নিয়োগের মাপকাঠি হল যোগ্যতা, বংশমর্যাদা নয়।
গুরুত্ব : এই ঘোষণাপত্রে শুধু ফ্রান্সের জনগণ নয়, সমগ্র মানবজাতির অধিকারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। ঐতিহাসিক ওলার বলেছেন যে, এই ঘোষণাপত্রটি ছিল “পুরাতনতন্ত্রের মৃত্যু পরোয়ানা”।
প্র। ফরাসি বিপ্লবে গ্রাম্য জনতার ভূমিকা কী ছিল?
(উত্তর) গ্রাম জনতার ভূমিকা : ফরাসি বিপ্লবে গ্রাম জনতার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। বাস্তিল দুর্গ অভিযান গ্রামের কৃষকদের উৎসাহিত করে। তারা অত্যাচারী সামন্তপ্রভুদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে, দলিলপত্র পুড়িয়ে ব্যাপক ও ভয়াবহ আন্দোলন করেছিল।
মহা আতঙ্ক : এই আন্দোলনের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল ‘মহা আতঙ্ক’ বা Great Fear। প্রাণের ভয়ে শহরে পালিয়ে গিয়েছিল অনেকে। এইভাবে গ্রামাঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ সফল হয়েছিল। ফরাসি সমাজের নীচুতলার মানুষ জেকোবিন দলের সমর্থক ছিল।
আবার লাব্রুস-এর মতে, নিত্যব্যবহার্য জিনিসের দাম কমলেও দিনমজুর ও শিল্প শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি, যা তাদের বিপ্লবের পথে নিয়ে যায়।
মন্তব্য : খাদ্যাভাব, অর্থাভাব, দুর্ভিক্ষ ও অজন্মার ফলে প্রতি গ্রাম যখন বারুদের স্তূপে পরিণত হয়েছিল, তখন ফরাসি সমাজের নীচুতলার মানুষ স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্রের অত্যাচার, যাজকদের দুর্নীতি, সামন্ততন্ত্রের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ফরাসি রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের সমাধি রচনা করেছিল।
প্র। ফরাসি বিপ্লবে নারীদের অবদান লেখ।
(উত্তর) ভূমিকা : সমাজের ‘নিষ্ক্রিয় নাগরিক’ হিসেবে অবহেলিত নারীরা কিন্তু ফরাসি বিপ্লবে পিছিয়ে ছিলেন না। তারাও বিপ্লবী আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর রাজপ্রাসাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সংঘটিত নারীদের মিছিল তার প্রমাণ। বাজারের সব্জি বিক্রেতা, জেলেনি ও অন্যান্য ছোটোখাটো কাজে নিযুক্ত মহিলারা এই ঐতিহাসিক মিছিলে যোগদান করেছিলেন।
অংশগ্রহণের কারণ : তখন প্যারিস ও তার আশপাশের অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে শুরু হয়েছিল খাদ্যের জন্য হাহাকার। মানুষের প্রয়োজনীয় রুটির আকাল তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে নারীরা আন্দোলনে অংশ নেয়।
খাদ্যের দাবিতে নারী আন্দোলন : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর প্রায় ৬ হাজার মহিলার এক মিছিল খাদ্যের দাবিতে ভার্সাই শহরের দিকে অগ্রসর হয়।
এই সময় লাফায়েত-এর নেতৃত্বে জাতীয় রক্ষী বাহিনীর সাহায্যে ৬ অক্টোবর রাজপরিবারের সদস্যদের বন্দি করে ভার্সাই থেকে প্যারিসে আসতে বাধ্য করা হয়। এই সময় বিপ্লবী জনগণের মুখে ধ্বনিত হয়েছিল – “আমরা রুটিওয়ালা, রুটিওয়ালার স্ত্রী ও পুত্রকে পেয়েছি – এবার আমরা রুটি পাবো।”
এই ঘটনার ফলে রাজা কার্যত তৃতীয় শ্রেণির হাতে বন্দি হয়ে পড়েন। ঐতিহাসিক রাইকার এই ঘটনাকে ‘রাজতন্ত্রের শবযাত্রা’ বলে অভিহিত করেছেন।
প্র। সামন্ততন্ত্রের বিলোপ সাধন সম্পর্কে লেখ।
(উত্তর) ভূমিকা : ফরাসি বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে রাজা ষোড়শ লুই তৃতীয় সম্প্রদায় তথা জাতীয় সভার উপর সংবিধান রচনার দায়িত্ব অর্পণ করলে জাতীয় সভা সংবিধান সভায় রূপান্তরিত হয়। সংবিধান সভা সংবিধান রচনার কাজ শুরু করার পূর্বে দুটি উল্লেখযোগ্য কাজ করে। প্রথমটি ৪ আগস্টের ঘোষণা এবং দ্বিতীয়টি হল ২৬ আগস্টের ঘোষণা।
৪ আগস্টের ঘোষণার নানাদিক : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট জাতীয় সভার অধিবেশনে ফ্রান্সে সামন্তপ্রথার বিলোপ করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে –
- সামন্তপ্রথার অবলুপ্তি হয়।
- পাশাপাশি ফ্রান্সে ভূমিদাস প্রথা, বেগার শ্রম বা করভি প্রথা, ধর্মকর, অভিজাতদের বিশেষ অধিকার যথা সরকারি চাকুরিতে অগ্রাধিকার, আইনের হাত থেকে অব্যাহতি, বৈষম্যমূলক কর, অন্তঃশুল্ক প্রথা প্রভৃতি লোপ পায়।
গুরুত্ব : ৪ আগস্টের ঘোষণা ফ্রান্সে সামন্তপ্রথার মৃত্যুঘণ্টা বাজায়। কারণ এই ঘোষণার ফলে জমিদার ও গির্জার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে কৃষকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
প্র। ফরাসি বিপ্লবের জনচেতনায় গুজবের প্রভাব লেখ।
(উত্তর) যে-কোনো আন্দোলন, বিপ্লব বা বিদ্রোহের মতো ফরাসি বিপ্লবের আগেও অবাস্তব সব অভিযোগের ভিত্তিতে সাধারণ মানুষ যাজক, অভিজাত, রাজা, রানি প্রমুখের বিরুদ্ধে গুজব রটিয়ে জনচেতনা বৃদ্ধি করেছিল। ফলত তা নানাভাবে বিপ্লবকে প্রভাবিত করেছিল।
- প্রথমত, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন গুজব রটে যে, রাজা ষোড়শ লুই তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে চলেছেন। এরপরেই তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা স্টেটস্ জেনারেলের সভাকক্ষ বন্ধ দেখে গুজবটি সত্য বলে ভাবেন এবং টেনিস কোর্টের শপথের মাধ্যমে বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেন।
- দ্বিতীয়ত, বাস্তিল দুর্গ আক্রমণকালে গুজব ছড়ায় যে, অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই কামানের মুখ জনতার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে জনমানসে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।
- তৃতীয়ত, ঐতিহাসিক লেফেভর-এর মতে, বাস্তিল দুর্গের পতনের পর কৃষকরা চার্চ ও সামন্তপ্রভুদের দেয় করগুলি বন্ধ করে দিলে কৃষকসমাজে গুজব ছড়ায় যে, ভূস্বামীরা গুন্ডাদের দিয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরফলে আতঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ কৃষকরা আরও হিংস্র হয়ে উঠে।
- চতুর্থত, কোবান-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ড (১৭৯২ খ্রি.-র ২৬ সেপ্টেম্বর) ঘটার আগে গুজব রটে যে, বিদেশি সেনাদল প্যারিসের মাত্র ২০০ মাইল দূরে রয়েছে। তারা প্যারিসে এসে বন্দি অভিজাতদের মুক্ত করবে এবং বিপ্লবীদের উপর আঘাত হানবে। অতএব এই আতঙ্কের ফলই হল ‘সেপ্টেম্বরের হত্যাকাণ্ড’।
- এইভাবে ফরাসি বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায়ে নানারকম গুজব বিপ্লবকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল।
প্র। ইউরোপ তথা বহির্বিশ্বে ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শের প্রভাব আলোচনা করো।
(উত্তর) ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব কেবল ফ্রান্সের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না, পরোক্ষভাবে এই বিপ্লবের দ্বারা ইউরোপ তথা সারা বিশ্বও প্রভাবিত হয়েছিল। এই বিপ্লব ছিল মানবজাতি তথা ইতিহাসের পটপরিবর্তনের অগ্রদূত। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শ প্রভাব বিস্তার করেছিল ফ্রান্সের সীমা ছাড়িয়ে বহির্দেশে।
আদর্শের প্রভাব :
- ইংল্যান্ড – ফরাসি বিপ্লবের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে লন্ডন, ম্যাঞ্চেস্টার প্রভৃতি শহরে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শ্রমজীবী সংগঠনগুলি ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়।
- আয়ারল্যান্ড – ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আয়ারল্যান্ডে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়।
- জার্মানি – জার্মানির লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের প্রসার ঘটান ও ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক শাসনকে স্বাগত জানান।
- বলকান অঞ্চল – ঐতিহাসিক জে এ আর ম্যারিয়ট বলেছেন, ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে বলকান জাতীয়তাবাদ প্রখর হয়ে ওঠে।
- ভারতবর্ষ – ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের মতো ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ পশ্চিম ভারতে গোপালহরি দেশমুখ, পূর্ব ভারতে ডিরোজিও, রামমোহন, দক্ষিণ ভারতে বীরেশলিঙ্গম, নারায়ণ গুরু প্রমুখের সংস্কার আন্দোলনে এবং ভারতের জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রামেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
মন্তব্য : ফ্রান্সের বাইরে ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন বা সাফল্য আনতে না পারলেও ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ ইউরোপ তথা বিশ্বে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রবাদের প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। ফরাসি বিপ্লব ইউরোপীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল, যা আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশে অবদান রেখেছে।
প্র। টীকা লেখো : অভিজাত বিদ্রোহ অথবা, অভিজাতরা কেন বিদ্রোহ করেছিল?
(উত্তর) অভিজাত বিদ্রোহ : ষোড়শ লুই ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা হওয়ার পর লক্ষ করেন যে, ফ্রান্সের রাজকোশ একেবারে শূন্য হয়ে পড়েছে। তিনি তুর্গো, নেকার, ক্যালোন, ব্রিয়া প্রমুখ অর্থমন্ত্রী নিয়োগ করে এই আর্থিক সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করলে অভিজাতরা রাজার বিরোধিতা করেন। পরবর্তীতে এই বিরোধিতা বিদ্রোহে পর্যবসিত হয়।
প্রেক্ষাপট : অভিজাতদের বিরোধিতার ফলে,
- রাজা বাধ্য হয়ে তাদের হাত থেকে আইন এবং কর সংক্রান্ত অধিকার কেড়ে নেন। ফলে ফ্রান্সের নানা স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। অভিজাতরা দাবি করেন যে, একমাত্র স্টেট জেনারেলের কর আরোপের অধিকার আছে।
- ষোড়শ লুই পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যের আচরণে উত্যক্ত হয়ে কয়েকজন সদস্যকে নির্বাসিত করেন। এতে পার্লামেন্ট ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং অভিজাতরা রাজার বিরুদ্ধে কয়েকটি আইন পাস করে ইচ্ছামতো নাগরিকদের গ্রেফতার, বিচারকদের অপসারণ প্রভৃতি বিষয়ে রাজার ক্ষমতা কেড়ে নেয়।
- পার্লামেন্টের আইনে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজা সমস্ত প্রদেশের পার্লামেন্টগুলি মুলতুবি করেন এবং নতুন বিচারালয় স্থাপন করে নিজের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলিকে আইনে পরিণত করেন।
বিদ্রোহের সূচনা : রাজা পার্লামেন্ট মুলতুবি করলে তার বিরুদ্ধে অভিজাতরা বিদ্রোহ শুরু করে দেন। রাজার বিরুদ্ধে অভিজাতদের বিদ্রোহে শীঘ্রই যাজক ও বুর্জোয়ারাও শামিল হন। ফলে অভিজাত বিদ্রোহ গণবিদ্রোহের আকার ধারণ করে। পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক সভা এই বিদ্রোহকে সমর্থন জানায়। এই অভিজাত বিদ্রোহ থেকেই ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়।
গুরুত্ব : বুরবোঁ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভিজাতদের বিদ্রোহ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা।
- এই অভ্যুত্থানে সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণি রাজার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। বুর্জোয়াদের সমর্থন এখানে স্মরণীয়।
- অভিজাত বিদ্রোহের চাপে রাজা স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হন, যা রাজার স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের মর্যাদায় আঘাত লাগে।
- রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।