Last Update : June 29, 2024
বিদ্যাপতির ভাব সম্মিলন কবিতা : প্রাক আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধ অংশই জুড়ে রয়েছে বৈষ্ণব সাহিত্য, যা বৈষ্ণব পদাবলিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। চৈতন্য-পূর্ব যুগের বৈষ্ণব পদ রচয়িতার মধ্যে দুজনের নামোল্লেখ করতে হয়, তাঁরা চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি। মৈথিলি কবি বিদ্যাপতির পদ বাংলা সাহিত্যের সম্পদ রূপে গণ্য হয়। ভাব সম্মিলন পর্যায়ের একটি পদ বা কবিতা একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় সেমেস্টারে সংকলিত হয়েছে “সাহিত্যানুশীলন” বইয়ে।
বিদ্যাপতির ভাব সম্মিলন কবিতার উৎস, সারাংশ, শব্দার্থ, পর্যায়, বিশ্লেষণ, Vab Sammilan by Vidyapati, Class 11 2nd Semester Poem
একদশ শ্রেণির দ্বিতীয় সেমেস্টারের কবিতা বিদ্যাপতির ভাব সম্মিলন
আলোচিত টপিক
ভাব সম্মিলন
বিদ্যাপতি
কি কহব রে সখি আনন্দ ওর।
চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।
পাপ সুধাকর যত দুখ দেল।
পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।।
আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই।
তব হাম পিয়া দূর দেশে না পাঠাই।।
শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা।
বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।
ভণয়ে বিদ্যাপতি শুন বরনারি।
সুজনক দুখ দিবস দুই-চারি।।
ভাব সম্মিলন কবিতার উৎস
- কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত “বৈষ্ণব পদাবলী” সংকলন।
- এছাড়াও আরো কয়েকটি বৈষ্ণব পদ সংকলন বৈষ্ণব পদ সংকলন গ্রন্থে এই কবিতাটি সংকলিত হয়েছে।
ভাব সম্মিলন কবিতা কোন পর্যায়ের
- কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত “বৈষ্ণব পদাবলী” সংকলন গ্রন্থে কবিতাটি “ভাবোল্লাস ও মিলন” পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
- তবে শিক্ষাসংসদের পাঠ্য অনুযায়ী এটি “ভাব সম্মিলন “ভাব সম্মিলন” পর্যায়ের। যদিও উভয়েই একার্থে প্রযোজ্য হয়েছে।
বিদ্যাপতির ভাব সম্মিলন কবিতার সারাংশ
শ্রীরাধিকা তাঁর সখীকে জানাচ্ছেন :
- হে সখি, আমার সীমাহীন আনন্দের কথা কী আর বলব; চিরকাল মাধব শ্রীকৃষ্ণ আমার হৃদয়-মন্দিরে থাকবেন।
- পাপী চন্দ্রকিরণ আমাকে যত না কষ্ট দিয়েছে, প্রিয় মাধবের মুখ দর্শনে আমি ততটাই সুখ পেয়েছি।
- যদি কেউ আঁচল ভরে মহামূল্যবান রত্নও দেয়, তবুও আমি প্রিয়তমকে দূর দেশে পাঠাবো না।
- প্রিয় আমার শীতের ওড়না, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছাতা, উত্তাল নদীর নৌকো মতো।
- বিদ্যাপতি বলেন, শুন ওহে বরনারী রাধিকা, যে হয় সুজন বা সৌভাগ্যবতী তাঁর দুঃখ চিরকালের নয় বরং স্বল্পকালের।
বিদ্যাপতির ভাব সম্মিলন কবিতার শব্দার্থ
- কহব = বলব
- সখি = সখী শব্দের সম্বোধন; বন্ধু, সহচরী
- ওর = সীমা-পরিসীমা (ব্রজবুলি শব্দ)
- চিরদিন = চিরকাল
- মাধব = শ্রীকৃষ্ণ
- মন্দির = কবিতায় ‘গৃহ’ অর্থে
- মোর = আমার
- সুধাকর = চাঁদের আলো, জ্যোৎস্না (সুধা কথার অর্থ চাঁদ)
- দুখ = দুঃখ
- দেল = দিল (ব্রজবুলি শব্দ)
- পিয়া = প্রিয় (এখানে কৃষ্ণ)
- দরশন = দর্শন (স্বরভক্তি ঘটেছে)
- ভেল = হলো (ব্রজবুলি শব্দ)
- আঁচর = অঞ্চল, আঁচল, শাড়ির প্রান্ত
- মহানিধি = মহামূল্যবান সম্পদ বা ধন
- তব = তবুও
- হাম = আমি
- ওঢ়নী = ওড়না, গায়ের আবরণ
- গীরিষের = গ্রীষ্মের (গ্রীষ্ম > গীরিষ)
- বা = বায়ু, বাতাস
- বরিষার = বর্ষাকালের (বর্ষা > বরিষা)
- ছত্র = ছাতা
- দরিয়া = নদী বা সমুদ্র
- ভণয়ে = বলছে, বলে
- শুন = শোনো
- বরনারি = সুন্দরী (এখানে রাধিকার সম্বোধনসূচক শব্দ)
- সুজনক = সৌভাগ্যবতীকে
- দুখ দিবস = দুঃখের দিন
- দুই-চারি = দু-চার দিনের
বিদ্যাপতির ভাব সম্মিলন কবিতার মূলসুর
শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় গমন করলে শুরু হয় রাধিকার বিরহ। এই বিরহ ও বিকারের আবেশে রাধা কল্পনার মাধ্যমে কৃষ্ণের সঙ্গ-সুখ উপভোগ করছেন – একেই ভাব সম্মিলন বা ভাবোল্লাস নাম দেওয়া হয়েছে। বিদ্যাপতির এই পদ বা কবিতাটিতেও বিরহে কাতর রাধাও যেন স্বপ্নে কিংবা কল্পনায় শ্রীকৃষ্ণের দেখা পেয়েছেন; তাই তাঁকে আর ছেড়ে দিতে চান না। অর্থাৎ এই পর্যায়ের কবিতাও প্রকান্তরে বিরহেরই কবিতা। ভাবসম্মিলন বা ভাবোল্লাস পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি হলেন বিদ্যাপতি। এই ভাবসম্মিলন বা ভাবোল্লাস পর্যায়ের আরও কয়েকটি কবিতা এখানে দেওয়া হলো,
- পিয়া যব আওব এ মঝু গেহে (বিদ্যাপতি)
- সই, জানি কুদিন সুদিন ভেল (চণ্ডীদাস)
- বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে (চণ্ডীদাস)
- আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ (বিদ্যাপতি)
- পহিলহি রাধামাধব মেলি (গোবিন্দদাস)
- অচিরে পূরব আশ / বন্ধুয়া মিলিবে পাশ (জ্ঞানদাস)
কবি বিদ্যাপতি পরিচয়
চৈতব্য-পূর্ব সময়ের বৈষ্ণব কবি। ইনি মিথিলার রাজসভার কবি ছিলেন। সংস্কত ও মৈথিলী ভাষায় বিদ্যাপতি কিছু গ্রন্থ ও গীতিকবিতা লিখেছেন। বাংলায় প্রচলিত তাঁর নামাঙ্কিত অধিকাংশ বৈষ্ণব পদ্গুলি আসলে ব্রজবুলিতে রচিত। আলোচ্য কবিতাটিও তাঁর ব্রজবুলিতে রচিত একটি পদ। ইনি শিবসিংহসহ কয়েকজন রাজার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন।
বিদ্যাপতি বাংলার বাইরের কবি হলেও তাঁর রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ্গুলিতে বাঙালি যে রসের সন্ধান পেয়েছে, তাকে একাত্ম করে নিয়েছে। দীনেশচন্দ্র সেনের কথায়, বিহারি বিদ্যাপতি পাগড়ি খুলে ধুতি-চাদর পড়েছেন।
একাদশ শ্রেণির প্রথম সেমেস্টার
একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় সেমেস্টার